প্রচ্ছদ ›› জাতীয়

স্বর্ণে বদলেছে ইন্দু-পরেশদের ভাগ্য

আফরিন আপ্পি
২৬ জুন ২০২৩ ১৮:২২:৪৯ | আপডেট: ২ years আগে
স্বর্ণে বদলেছে ইন্দু-পরেশদের ভাগ্য

নাম তার ইন্দু। অভাবের তাড়নায় মাত্র ১৪ বছর বয়সে হাল ধরেন সংসারের। কাজ নেন স্বর্ণের দোকানে কারিগর হিসেবে। যে বয়সে ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, সেই দুরন্ত কৈশোরেই ইন্দুর কাঁধে ওঠে সংসারের বোঝা। বই-খাতার পরিবর্তে বদ্ধরুমে কয়লা আর আগুনের তাপ হয় নিত্যসঙ্গী। ঘামে-শ্রমে ছোট্ট কচি হাতে গড়ে উঠতে থাকে একের পর এক স্বর্ণালংকার।

নামমাত্র মজুরিতে কাজ শিখেছিলো ইন্দু। পরিবারের অভাব মেটাতে পরিশ্রম করত উদয়াস্ত। কাজ করতে করতে কখন রাত পেরিয়ে ভোরের আলো ফুটতো জানা হতো না তার। সময়টা বেশ কঠিন হলেও এখন হাসি ফুটেছে ইন্দুর মুখে।

১৪ বছরের ইন্দু এখন ৩০ বছরের যুবক। সে আর অন্যের দোকানের কারিগর নয়। ৭ বছর হলো চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলায় নিজেরই একটি দোকান হয়েছে। সেখানে তিনিসহ কাজ করেন আরও ৩ জন।

বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দামের ঊর্ধ্বগতিতে ইন্দুর কিছুটা টানাপোড়ন চললেও আগের মত হাহাকার নেই তার। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বেশ ভালো কাটছে সময়। ইন্দু স্বপ্ন দেখে তার সন্তান ভালোভাবে লেখাপড়া শিখে সমাজের উঁচু তলার মানুষ হবে।

এমনই আরেকজন দেবেশ কুমার। চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলায় স্বর্ণপট্টিতে দেখা মেলে তার। দ্য বিজনেস পোস্টের সাথে আলাপকালে তুলে ধরেন জীবনের কঠিন সংগ্রামের গল্প। তীব্র অভাবের কারণে বই কিনতে না পারায় এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়া হয় না দেবেশের। বাবার স্বল্প আয়ে কোনোরকমে চলত ৫ ভাই ৩ বোনের সংসার। এক ভাই ছিলো ক্যান্সার আক্রান্ত আরেক ভাইয়ের মৃত্যু হয় পেটের রোগে ভুগে। অসহায় দেবেশ কী করবেন ভেবে পান না। এর-ই মাঝে চাচাতো বোনের সহায়তায় কাজ নেন জুয়েলারি দোকানের কারিগর হিসেবে।

চালের অভাবে বাড়িতে রান্না হতো না প্রায়-ই। মাঝে মাঝে মহাজনের কাছে চাল চাইতেন  ভাত রান্নার জন্য। একমুঠো ভাত পাওয়াটাই তখন দেবেশের জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

কাজ শিখতে লেগে যায় ৫ থেকে ৬ বছর। মহাজনের অনাগ্রহে সময়টা তুলনামূলক বেশি লাগে।

এখন দিন বদলেছে সেই দেবেশের। ৪৩ বছর বয়সী দেবেশের হাতে গড়ে উঠেছে প্রায় ১০ থেকে ১২ জন দক্ষ স্বর্ণের কারিগর। যাদের নিজস্ব স্বর্ণের ব্যবসা রয়েছে।

রাজধানীর স্বর্ণপট্টিখ্যাত তাঁতীবাজার ও দেশের বিভিন্ন উপজেলার প্রান্তিক পর্যায়ের ক্ষুদ্র স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের দুঃখ-কষ্ট, পাওয়া না পাওয়া বেদনার গল্প। প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের পুঁজি স্বল্প হওয়ায় হিমশিম খেতে হয় প্রতিনিয়ত। মহাজনরাও করেন না ভরসা। নগদ অর্থ ব্যতীত দিতে চান না ১ থেকে ২ পিসের বেশি স্বর্ণ।

স্বর্ণালংকার তৈরীর দোকানগুলোয় ঘুরে দেখা যায় কাঠ কয়লার তাপে মাটির ছোট পাত্রে নির্দিষ্ট পরিমাণ তাপে স্বর্ণ গলিয়ে তরল করা হয়। বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে এরপর অলংকারের গায়ে চিমটার সাহায্যে তোলা হয় নকশা। কোনোটায় আবার সৌন্দর্য বর্ধনে ব্যবহার করা হয় রং-বেরংয়ের পাথর। রাজধানীর বড় দোকানগুলোয় যে মনকাড়া ডিজাইনের স্বর্ণালঙ্কার দেখা যায় সেগুলো বেশিরভাগ তৈরী হয় তাঁতীবাজারে।

পুরো বাংলার স্বর্ণপট্টি বলা হয় তাঁতীবাজারকে। সেখানে প্রায় ৭শ’ ৫০টি দোকান আর ৫শ’৫০টি কারখানা রয়েছে। বাংলাদেশের স্বর্ণ শিল্পের গোড়াপত্তন তাঁতীবাজারে। এসব দোকানের কোথাও অবার স্বর্ণ বন্ধক রেখে নির্দিষ্ট সুদের বিনিময়ে টাকা দেন ব্যবসায়ীরা। এ প্রথার পুরোটাই নির্ভর করে ব্যবসায়ী ও অর্থ গ্রহণকারীর সম্পর্কের ওপর।

বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির (বাজুস) তথ্যমতে, সারাদেশে ৪০ হাজার জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রায় ৪৪ লাখ মানুষ কর্মরত রয়েছে।

আগামীতে এই শিল্পে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে বাজুস।

ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের ২০২২ সালের প্রতিবেদন মোতাবেক বিশ্ববাজারে স্বর্ণের চাহিদা ছিল ৪ হাজার ৭৪০ টন। এর মধ্যে অলংকারের চাহিদা ছিলো ২ হাজার ১৮৯ দশমিক ৮ টন।

বাজুস বলছে, অপার সম্ভাবনা থাকার পরও সুষ্ঠু রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও নীতি সহায়তার অভাবে বাংলাদেশের জুয়েলারি শিল্প এখন হুমকির মুখে।

তবে আশার কথা হলো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে প্রথম বেসরকারিভাবে স্বর্ণ পরিশোধনাগার স্থাপন হয়েছে। এই পরিশোধনাগার স্থাপনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির আমদানি শুল্ক অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি বলে জানিয়েছে জুয়েলারি সমিতি।

দেশের প্রান্তিক পর্যায় থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিকভাবে স্বর্ণের বাজার বিস্তারে রিফাইনারি গোল্ড ইন্ডাস্ট্রির কোনো বিকল্প নেই উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ দ্য বিজনেস পোস্ট ’কে বলেন, “একটা সময় ছিলো যখন মানুষ স্বর্ণে বিনিয়োগ করতো। কিন্তু দাম বৃদ্ধির ফলে এখন সেই অবস্থা থেকে সরে এসেছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের স্বর্ণের ইন্ডাস্ট্রি ৫০ বিলিয়ন ডলারের। স্বর্ণ পলিসিতে রিফাইনারি গোল্ড ইন্ডাস্ট্রি হবে অনেকদিন ধরে শুনছি। এটা হলে ইন্ডাস্ট্রির ব্যপ্তি বাড়বে বলে আশা করছি। বিদেশে মানুষ শেয়ারবাজার এবং জমির মত স্বর্ণেও বিনিয়োগ করে। ”

“আমরা একটি গোল্ড ইন্ডাস্ট্রির আশা করছি। সেটি না হওয়ায় বাংলাদেশে গোল্ডের কোনো ট্রেডিং হচ্ছে না। বাংলাদেশ এখন দুবাই থেকে স্বর্ণ আমদানি করছে কিন্তু নিজেরা স্বর্ণ রপ্তানি করতে পারছে না।”

“রিফাইনারি ইন্ডাস্ট্রি হলে প্রান্তিক পর্যায়ের স্বর্ণকার যারা আছেন তারা উপকৃত হবেন। ভালো স্বর্ণ কিনে এলাকায় নিয়ে বিক্রি করতে পারবেন। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা মূলত সেকেন্ড হ্যান্ড স্বর্ণ নিয়ে কাজ করে এভাবে স্বর্ণের বাজারের প্রসার সম্ভব নয়।”

স্বর্ণের বাজার দেশে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হলে এই কারিগররাই প্রয়োজনে বিদেশ গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসত। বড় বড় গ্রুপগুলো যদি এক্ষেত্রে এক হয়ে কাজ করে তাহলে স্বর্ণ ব্যবসায় সুদিন আশা করা যায় বলে মন্তব্য করেন এ অর্থনীতিবিদ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের রপ্তানি শিল্পের প্রায় পুরোটাই তৈরি পোশাক নির্ভর। ভেনিজুয়েলার আর্থিক ধসের চিত্র তুলে ধরে বিষয়টি যে কোন দেশের জন্য ভয়াবহ বলে মন্তব্য করেছেন তারা।

স্বর্ণ শিল্পীদের হাতে তৈরি অলংকারের জনপ্রিয়তা শীর্ষে। নানা প্রতিবন্ধকতায় জুয়েলারি শিল্প রপ্তানি খাত হিসেবে যতটুকু অবদান রাখতে পারত, তার সিকি ভাগও হয়নি। শিল্প সংশ্লিষ্টরা মনে করেন ২০২৬ সালের মধ্যে সরকার যে ১০০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে সেটি পূরণে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে জুয়েলারি শিল্প।

এক্ষেত্রে প্রান্তিক পর্যায়ের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অবহেলিত রেখে কোনোভাবে এ খাতের উন্নয়ন সম্ভব কিনা প্রশ্ন করা হলে বাজুসের সাধারণ সম্পাদক দিলিপ কুমার আগরওয়ালা দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, “বাংলাদেশের স্থানীয় স্বর্ণ বাজারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারের স্বর্ণমূল্যের ব্যবধান সবসময় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা বেশি। ফলে উৎপাদনের প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে প্রত্যেক ধাপে ব্যয় বেড়ে যায়। এর অন্যতম কারণ কাঁচামাল ও মেশিনারিজ আমদানিতে অসহনীয় শুল্ক-কর হার। ফলে প্রতি ধাপে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবাই।”

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ভাগ্যোন্নয়নে বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কিনা জানতে চাওয়া হলে আগরওয়ালা বলেন, “আমরা কেরানীগঞ্জে ‘জুয়েলারি শিল্পাঞ্চল’ গড়ে তুলতে চাচ্ছি। এটি সফল হলে প্রান্তিক কারিগররা লাভবান হবে। এ বিষয়ে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথাও বলেছি।”

“আমরা দেখেছি কারিগররা খুব অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করে। আমরা যদি তাদের কাজের একটা ভালো পরিবেশ দেই তাহলে তাদের কর্মদক্ষতা বাড়বে। জীবনমানের উন্নয়ন হবে। আবার প্রান্তিক পর্যায়ে যেসব ব্যবসায়ীরা রয়েছেন তারা এখন খুব বেশি স্বর্ণ কিনতে পারে না। এজন্য বাংলাদেশে বসুন্ধরা গ্রুপ স্বর্ণ পরিশোধনাগার স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে বাজারে স্বর্ণের সরবরাহ বাড়বে। থাকবে না সঙ্কট।

ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর স্বর্ণের চাহিদা ছিল ৪৫০ দশমিক ১ টন। যা ২০২২ সালে ১৫২ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৩৫ দশমিক ৭ টন। অর্থাৎ এ সকল দেশগুলোর বুলিয়ন মার্কেটে বড় ক্রেতাই হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো। যা সে সকল দেশগুলোর অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। বাংলাদেশেও সোনা পরিশোধনাগার স্থাপনের লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে। এই পরিশোধনাগারকে প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে কর অবকাশ বড় ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

বাজুস বলছে, কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে প্রতিনিয়ত স্থানীয় পোদ্দার বা বুলিয়ন বাজারে সোনার দাম বাড়ানো হচ্ছে। পোদ্দারদের সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে সোনার পাইকারি বাজার। পোদ্দারদের সঙ্গে চোরাকারবারিদের সিন্ডিকেটের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যে কারণে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে স্থানীয় পোদ্দার বা বুলিয়ন বাজারেও সোনার দাম বাড়ানো হচ্ছে। ফলে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রান্তিক পর্যায় থেকে শুরু করে সব স্তরের ব্যবসায়ীরা।

সঙ্কট নিরসনে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর যদি তা করা সম্ভব হয় তাহলেই ঘুরে দাঁড়াবে প্রান্তিক পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বস্তরের ব্যবসায়ীরা। ফলে প্রসার ঘটবে ব্যবসার। গতিশীল হবে অর্থনীতি। বিশ্ববাজারে জায়গা করে নেবে মেইড ইন বাংলাদেশ লেখা স্বর্ণ।